১৫ আগস্ট, নিজস্ব প্রতিনিধি
ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী পূর্বকান্দা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে দিপু মিয়ার (২১) পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে নয় লাখ টাকা নেন স্থানীয় এক দালাল। কথা ছিল লিবিয়া থেকে সাগর দিয়ে ইতালী পৌঁছে দিবে। এরই মধ্যে এক বছর ১০ মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে দিপুর আর ইতালি যাওয়া হলোনা । সময় কাটছে লিবিয়ায় দালাল চক্রের আস্তানায়, না হয় মাফিয়া চক্রের গোপন বন্দিশালায়। কিছু দিন পর পর বন্দিশালায় মুখে কাপড় বেঁধে দিপুর ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। আর ভিডিও কলে নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হয় পরিবারের সদস্যদের। চাওয়া মাত্র টাকা দিলে থামে নির্যাতন, এই বিরতি সাময়িক।

দিপুর পরিবারের দাবি, ইতালি পৌঁছে দেওয়া আর নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার আশায় দালাল ও মাফিয়া চক্র পরিবারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ফের নতুন করে চাওয়া হয় ২৫ লাখ টাকা।
দিপুকে বাঁচাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারটি দাবির ২৫ লাখের মধ্যে পাঁচ লাখ দিতে পেরেছে। মেরে ফেললেও আর দেওয়া সম্ভব নয়- পরিবার থেকে এই কথা জানানোর পর সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই মুখে কাপড় বেঁধে দিপুর ওপর চালানো নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আজ শুক্রবার দুপুরে মানিকদী পূর্বকান্দার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দিপুদের দুচালা টিনের ঘর। পরিবারের সদস্যরা এক সঙ্গে হয়ে দিপুর বিষয়ে কথা বলছেন। সবার মন ভার।
প্রসঙ্গ উঠতেই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে দিপুর বড় ভাই মো. অপু বলেন, এই দৃশ্য (নির্যাতন) দেখা কঠিন। তবুও দেখতে হয়। নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে গিয়ে সব শেষ করেছি। ভিটিমাটি বিক্রি করছি। এখন আর কিছু করার ক্ষমতা নাই আমাদের।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাত ভাই বোনের মধ্যে দিপু ছয় নম্বর। তিন বছর আগে মা জেসমিন বেগম মারা যান। একই গ্রামের মফিজ কাজীর ছেলে ফজলুল হক সাত বছর ধরে বিদেশ লোক পাঠানোর কাজ করে আসছেন। তাঁর মাধ্যমে অনেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন, অনেকে পারেননি। আবার অনেকে বিপদে পড়েছেন। বাড়ির পাশের বলে দিপু দালাল ফজলুল হকের মাধ্যমে বিদেশ যেতে আগ্রহী হন। শেষে লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে তাঁর মাধ্যমে সাড়ে নয় লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর লিবিয়া পৌঁছান দিপু। কয়েক দিন পর জানতে পারেন দিপু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন। পরে মাফিয়া চক্রের হাতে চলে যায়। দেড় মাস পর ফোন আসে পরিবারের কাছে। নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে একদিনের মধ্যে ১১ লাখ টাকা দাবি করা হয়। চাহিদার সব টাকা দিয়ে মুক্ত হবার পর দিপু চলে যান দালাল ফজলুল হকের নিয়ন্ত্রণে। দালালের অধীন থাকেন চারমাস। ইতালি পৌঁছে দিতে এবার দালাল ১০ লাখ দাবি করে বসেন। দেওয়া হয় টাকা। বোটেও উঠানো হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর বিপদ বুঝতে পেরে ফিরিয়ে আনা হয়। এইভাবে কেটে যায় আরও চারমাস। দ্বিতীয়বার পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নতুন করে দাবি করা হয় নয় লাখ টাকা। টাকা পাবার পর দালাল দ্বিতীয়বার সাগর পথে পৌঁছে দিতে বোটে উঠান। আলবেনিয়ার কাছে যাওয়ার পর ফের এক চক্রের হাতে দিপু আটক হন। পাঁচ লাখ দিয়ে ছাড়া পাবার পর দিপুকে দালাল ফজলু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। আট মাস টাকা চাননি, নির্যাতনের ভিডিও দেখানো হয়নি। চলতি বছরের ১৫ জুলাই দালাল ফজলু সাড়ে আট লাখ টাকা চান। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা দিতে রাজি হননি। একদিন পর ১৬ জুলাই বাসা থেকে একটি চক্র এসে দিপুকে ধরে নিয়ে যায়। ২৪ জুলাই থেকে নির্যাতনের ভিডিও দেখানো শুরু হয়। ভিডিও চালু রেখে মারা হয়। নির্যাতন বন্ধ ও ছাড়া পেতে দিতে হবে ২৫ লাখ- এমন দাবির কথা শুনে পরিবারটি এখন আরও অসহায় হয়ে পড়ে।
বাড়িতে গিয়ে কথা হয় দিপুর বোনের স্বামী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর ২০ বছরের প্রবাস জীবন। কিছুদিন আগে সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন। নজরুল ইসলাম বলেন, নির্যাতনের দৃশ্য দেখার পর পকেটে টাকা রেখে বসে থাকা যায় না। আমিও সাধ্যমত টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এত টাকা দেবার পরও নির্যাতন আর থামছে না।
দিপুর বাড়ির কিছুটা দূরে দালাল ফজলুর দ্বিতল বাড়ি। ফটক বন্ধ। কিছুক্ষণ পর ছোট বোন নার্গিস বেগম ফটকে দাঁড়িয়ে বলেন, ভাই দেশে নেই। বিদেশ আছেন। দিপুর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন দিপুকে বন্দিশালা থেকে মুক্ত করতে ভাই অনেক চেষ্টা করছেন।
এবিষয়ে এলাকার ব্যক্তি এবি সিদ্দিক ও জাকির হোসেন বলেন আমরা ঘটনাটি জেনে স্থানীয়ভাবে টাকা তুলছি। কারন পরিবারটি দিপুকে বাঁচাতে আজ নিস্বঃ হয়ে গেছে। তাদের টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই।
বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শবনম শারমিনের নজরে আনা হয়। ভিডিও দেখে তিনি বলেন, প্রতিকারে কী করা যায়- তা তিনি ভেবে সিদ্ধান্ত নিবেন।