চোখের জল আর বুক ফাঁটা আর্তনাদ করে ভৈরবের   জুবায়েরের মা বাবার দিন কাটছে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো পরিবারের কান্না

  • Reporter Name
  • Update Time : ০১:৪৩:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
  • ২১৪ Time View

২০ আগস্ট, নিজস্ব প্রতিনিধি

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার শনির আখড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত ভৈরবের কিশোর জুবায়ের হোসেন (১৬) হত্যার বিচার দীর্ঘ এক বছরেও শুরু হয়নি। ঘটনার  হতাশা ব্যক্ত করেছেন সন্তান হারা মা হোসনেআরা বেগম। আদালতে  তিনি নিজে বাদী হয়ে মামলা করার পরও সন্তান হত্যার বিচার কেনো পাচ্ছেন না, জিজ্ঞাসা তাঁর।

পুত্রশোকে পাগলপ্রায় মা হোসনেআরা বেগমের চোখের জল আর বুক ফাঁটা আর্তনাদই যেনো এখন তাঁর নিত্য সঙ্গী। তিনি কোনো অর্থ সম্পদ চান না। শুধু চান তার বুকের ধনকে যারা এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিচার। 

জানা যায়, ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের গোকুল নগর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে হোসনেরা বেগম। বিয়ে হয় ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার  আখাউড়ার সুলতানপুর এলাকায়। স্বামী নাজির হোসেন  ভিটেমাটিহীন হওয়ায় তিনি থাকেন বাবার বাড়িতে। তার দুই ছেলে জুবায়ের হোসেন (১৬)  ও জুনায়েদ হোসেন (১৪) । প্রায়ই অসুস্থ থাকা দিনমজুর স্বামীর সংসারের চারকোণে শুধুই অভাব। দুই ছেলেকে নিয়ে তাই তার চরম অভাবে কাটে জীবন।

জুবায়ের পড়াশোনায় বেশ ভালো। কিন্তু ক্লাস সেভেনের গন্ডি পার হওয়ার পরই রোজগারের আশায় কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখে। ২০২৪ সালের শুরুতে জানুয়ারি মাসে  জুবায়ের  মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকার শনির আখড়ায় চলে যায়। সেখানে একটি ফার্ণিচারের কারখানায় ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করে। থাকত শনির আখড়ায় বাসা ভাড়া করে। বাবা নাজির হোসেন মাঝেমধ্য ভ্যান গাড়ী চালাত। 

ঢাকায় সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে, জুবায়ের ছাত্রদের সাথে যোগ দিতে থাকে। মা সেটি জেনে তাকে নিষেধ করেন। কিন্তু মায়ের নিষেধ সত্বেও গত বছর  ৪ আগস্ট  সে আন্দোলনে শরিক হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে  দুপুর বা বিকালে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।

হোসনেআরা বেগম জানান, ৪ আগস্ট রোববার দুপুরে কাজ থেকে বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে আবারও কাজে যাওয়ার কথা থাকলেও, দুপুর শেষে বিকেল নামলে মায়ের মনে দুশ্চিন্তা বাসা বাধে। তিনি অস্থির চিত্তে ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। শনির আখড়া এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ছেলের সন্ধান না পেয়ে এক প্রতিবেশী নারীকে সাথে নিয়ে যাত্রাবাড়িসহ আশে পাশের এলাকায় খোঁজ করেন । সেখানেও মিলে না ছেলের খোঁজ।

রাতে স্বামীকে নিয়ে ওইসব এলাকার হাসপাতালগুলিতে সন্ধান করে বেড়ান, ধারনা, যদি ছেলে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যেয়ে থাকে। কিন্তু মেলে না খোঁজ।  পরের দিন ৫ আগস্ট ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশ খোঁজে পান। লাশের ময়না তদন্ত হয়নি বলে জানান তিনি। এক প্রত্যক্ষদর্শী তাকে জানিয়েছেন জুবায়ের পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। লাশের শরীরে কয়েকটি গুলির চিন্হ দেখতে পায় মা। 

তরতাজা ছেলেকে সাথে নিয়ে ঢাকা যাওয়া হয় কিন্ত সেই ছেলের লাশ নিয়ে ভৈরবে ফেরেন এবং গ্রামের কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করেন। এলাকাবাসীও সেদিন লাশ দেখে কেদেঁছে। 

ছেলে হারা মা হোসনেআরা আরও জানান, তিনি অনেক কষ্ট করে ছেলে দুটিকে লালন পালন করেছেন। সংসারে অভাব থাকলেও তাঁর ছেলেদের তিনি অনেক আদর আর যত্ন করে বড় করেছেন। কখনও তিনি তাদের গায়ে আঘাত করে শাসন করেননি। তিনি আরও বলেন, জুবায়ের কখনও কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতো না।

জুবায়ের মা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলের হত্যার ঘটনায় ভৈরবের অপরিচিত এক যুবক মনির হোসেন ৯০ জনকে আসামী করে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করেন। বাদীকে আমি চিনিনা। শুনেছি আসামীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায়ের জন্য সে আমাকে না জানিয়ে মামলা করে। ভৈরবের যাদেরকে আসামী করেছে তারা কেউ আমার ছেলেকে হত্যা করেনি। কারন ভৈরবে আমার ছেলের কোন শত্রু ছিলনা। পরবর্তীতে আমি পুলিশ সদস্যদেরকে আসামী করে ঢাকার আদালতে মামলা করেছি। আমার মামলার তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি যা আমি জানতে পারি। 

তিনি সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা নয়, ছেলে হত্যার বিচার চান। কয়েকমাস আগে তিনি নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এখনও এর অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি দ্রুত ছেলে  হত্যাকারীদের বিচার দেখতে চান, এদাবি তার। 

জুবায়েরের বাবা নাজির হোসেন বলেন, আমার জীবন্ত ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করে মারল। আমি বিচার চাই। জুবায়েরের নানা বাচ্চু মিয়া বলেন, আমার নাতিটার কোন দোষ ছিলনা। হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নাতিটার জীবন গেল। জানতেও পারলামনা কিভাবে কখন মারা গেল। ছেলের মৃত্যুর শোকে আমার মেয়ের পরিবারে এখনও কান্না থামেনি। 

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন জানান, সরকারের দেওয়া শহীদ পরিবারের জন্য বরাদ্ধকৃত সকল সুযোগ-সুবিধা শহীদ জুবায়ের হোসেনের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারি অর্থে তাঁর কবর সংরক্ষণের জন্য পাকাকরণ করা হয়েছে। জুবায়েরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি আমরা লিখিতভাবে সরকারকে অবহিত করেছি। ভবিষ্যতে সরকার হয়তো আরও সহযোগীতা করতে পারে। আর বিচারের বিষয়টি সরকার দেখবে। 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ নীতিমালা -২৫ পেছানো দাবি ডিলার এসোসিয়েশনের। যৌক্তিক কমিশন নির্ধারণ করার দাবি। 

চোখের জল আর বুক ফাঁটা আর্তনাদ করে ভৈরবের   জুবায়েরের মা বাবার দিন কাটছে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো পরিবারের কান্না

Update Time : ০১:৪৩:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

২০ আগস্ট, নিজস্ব প্রতিনিধি

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার শনির আখড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত ভৈরবের কিশোর জুবায়ের হোসেন (১৬) হত্যার বিচার দীর্ঘ এক বছরেও শুরু হয়নি। ঘটনার  হতাশা ব্যক্ত করেছেন সন্তান হারা মা হোসনেআরা বেগম। আদালতে  তিনি নিজে বাদী হয়ে মামলা করার পরও সন্তান হত্যার বিচার কেনো পাচ্ছেন না, জিজ্ঞাসা তাঁর।

পুত্রশোকে পাগলপ্রায় মা হোসনেআরা বেগমের চোখের জল আর বুক ফাঁটা আর্তনাদই যেনো এখন তাঁর নিত্য সঙ্গী। তিনি কোনো অর্থ সম্পদ চান না। শুধু চান তার বুকের ধনকে যারা এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিচার। 

জানা যায়, ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের গোকুল নগর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে হোসনেরা বেগম। বিয়ে হয় ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার  আখাউড়ার সুলতানপুর এলাকায়। স্বামী নাজির হোসেন  ভিটেমাটিহীন হওয়ায় তিনি থাকেন বাবার বাড়িতে। তার দুই ছেলে জুবায়ের হোসেন (১৬)  ও জুনায়েদ হোসেন (১৪) । প্রায়ই অসুস্থ থাকা দিনমজুর স্বামীর সংসারের চারকোণে শুধুই অভাব। দুই ছেলেকে নিয়ে তাই তার চরম অভাবে কাটে জীবন।

জুবায়ের পড়াশোনায় বেশ ভালো। কিন্তু ক্লাস সেভেনের গন্ডি পার হওয়ার পরই রোজগারের আশায় কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখে। ২০২৪ সালের শুরুতে জানুয়ারি মাসে  জুবায়ের  মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকার শনির আখড়ায় চলে যায়। সেখানে একটি ফার্ণিচারের কারখানায় ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করে। থাকত শনির আখড়ায় বাসা ভাড়া করে। বাবা নাজির হোসেন মাঝেমধ্য ভ্যান গাড়ী চালাত। 

ঢাকায় সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে, জুবায়ের ছাত্রদের সাথে যোগ দিতে থাকে। মা সেটি জেনে তাকে নিষেধ করেন। কিন্তু মায়ের নিষেধ সত্বেও গত বছর  ৪ আগস্ট  সে আন্দোলনে শরিক হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে  দুপুর বা বিকালে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।

হোসনেআরা বেগম জানান, ৪ আগস্ট রোববার দুপুরে কাজ থেকে বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে আবারও কাজে যাওয়ার কথা থাকলেও, দুপুর শেষে বিকেল নামলে মায়ের মনে দুশ্চিন্তা বাসা বাধে। তিনি অস্থির চিত্তে ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। শনির আখড়া এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ছেলের সন্ধান না পেয়ে এক প্রতিবেশী নারীকে সাথে নিয়ে যাত্রাবাড়িসহ আশে পাশের এলাকায় খোঁজ করেন । সেখানেও মিলে না ছেলের খোঁজ।

রাতে স্বামীকে নিয়ে ওইসব এলাকার হাসপাতালগুলিতে সন্ধান করে বেড়ান, ধারনা, যদি ছেলে আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যেয়ে থাকে। কিন্তু মেলে না খোঁজ।  পরের দিন ৫ আগস্ট ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশ খোঁজে পান। লাশের ময়না তদন্ত হয়নি বলে জানান তিনি। এক প্রত্যক্ষদর্শী তাকে জানিয়েছেন জুবায়ের পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। লাশের শরীরে কয়েকটি গুলির চিন্হ দেখতে পায় মা। 

তরতাজা ছেলেকে সাথে নিয়ে ঢাকা যাওয়া হয় কিন্ত সেই ছেলের লাশ নিয়ে ভৈরবে ফেরেন এবং গ্রামের কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করেন। এলাকাবাসীও সেদিন লাশ দেখে কেদেঁছে। 

ছেলে হারা মা হোসনেআরা আরও জানান, তিনি অনেক কষ্ট করে ছেলে দুটিকে লালন পালন করেছেন। সংসারে অভাব থাকলেও তাঁর ছেলেদের তিনি অনেক আদর আর যত্ন করে বড় করেছেন। কখনও তিনি তাদের গায়ে আঘাত করে শাসন করেননি। তিনি আরও বলেন, জুবায়ের কখনও কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতো না।

জুবায়ের মা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলের হত্যার ঘটনায় ভৈরবের অপরিচিত এক যুবক মনির হোসেন ৯০ জনকে আসামী করে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করেন। বাদীকে আমি চিনিনা। শুনেছি আসামীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায়ের জন্য সে আমাকে না জানিয়ে মামলা করে। ভৈরবের যাদেরকে আসামী করেছে তারা কেউ আমার ছেলেকে হত্যা করেনি। কারন ভৈরবে আমার ছেলের কোন শত্রু ছিলনা। পরবর্তীতে আমি পুলিশ সদস্যদেরকে আসামী করে ঢাকার আদালতে মামলা করেছি। আমার মামলার তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি যা আমি জানতে পারি। 

তিনি সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা নয়, ছেলে হত্যার বিচার চান। কয়েকমাস আগে তিনি নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এখনও এর অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি দ্রুত ছেলে  হত্যাকারীদের বিচার দেখতে চান, এদাবি তার। 

জুবায়েরের বাবা নাজির হোসেন বলেন, আমার জীবন্ত ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করে মারল। আমি বিচার চাই। জুবায়েরের নানা বাচ্চু মিয়া বলেন, আমার নাতিটার কোন দোষ ছিলনা। হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নাতিটার জীবন গেল। জানতেও পারলামনা কিভাবে কখন মারা গেল। ছেলের মৃত্যুর শোকে আমার মেয়ের পরিবারে এখনও কান্না থামেনি। 

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন জানান, সরকারের দেওয়া শহীদ পরিবারের জন্য বরাদ্ধকৃত সকল সুযোগ-সুবিধা শহীদ জুবায়ের হোসেনের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারি অর্থে তাঁর কবর সংরক্ষণের জন্য পাকাকরণ করা হয়েছে। জুবায়েরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি আমরা লিখিতভাবে সরকারকে অবহিত করেছি। ভবিষ্যতে সরকার হয়তো আরও সহযোগীতা করতে পারে। আর বিচারের বিষয়টি সরকার দেখবে।