ভৈরবের মৌটুপি গ্রামে আবারও দুই পক্ষের সংঘর্ষে বাড়ীঘর ভাঙচুর লুটপাট। মানুষ পালিয়েছে। শান্তি কমিটি করার পর অশান্ত হয়ে গেছে গ্রাম।

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৬:০৩:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৯৭ Time View

২৬ এপ্রিল, নিজস্ব প্রতিনিধি:
ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মৌটুপি গ্রামটি এলাকাবাসী ও পুলিশের কাছে দাঙ্গাবাজ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। গ্রামের কর্তা ও সরকার বংশ দুই পক্ষের শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ৫৫ বছর যাবত চলছে ঝগড়া – সংঘর্ষ, বিবাদ। এই গ্রামে আবারও দুই পক্ষের সংঘর্ষে শতাধিক বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘরবাড়ী এখন ধ্বংসস্তুুপে পরিণত হয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল মৌটুপি গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ঘটনাটি ঘটে। এই গ্রামের বিবাদ পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে তিনদিন পর ১৮ এপ্রিল শুক্রবার সকালে মিজান মিয়া নামের একজন প্রতিপক্ষের আঘাতে নিহত হয়। এসব সংঘর্ষের ঘটনার পর একাধিক পরিবার ভয় আতংকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাড়ীঘরে থাকতে পারছেনা। কারন ধ্বংসস্তুুপ বাড়ীতে থাকার মত কোন পরিবেশ নেই, আবার প্রতিপক্ষ ও পুলিশ আতংক। বংশীয়পরায়ণ শত্রুতায় ৫৫ বছরে দুইপক্ষের ১৮ জন খুন হয়েছে। গ্রামের আধিপত্য ও শত্রুতার নেপথ্যের নায়ক দুই ইউপি চেয়ারম্যান। একজন সাদেকপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মোঃ সাফায়েত উল্লাহ। তিনি সরকার বংশের নেতৃত্ব দেন। অপরজন একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা মোঃ তোফাজ্জল হক। তিনি কর্তা বংশের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তারা বংশ পরায়ণভাবে একে অপরের শত্রু। একদিকে তাদের দল, অপরদিকে চেয়ারম্যান হওয়ার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা তাদের গোস্টির লোকজন নিয়ে বার বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কর্তা বংশের নেতা তোফাজ্জল হক বাড়ীতে থাকেননা, থাকেন ভৈরব শহরের বাসায়। শহরে থেকেই বিএনপির রাজনীতি করেন এবং গ্রামের আধিপত্বের কলকাঠি নাড়েন বংশের লোকজন দিয়ে। অপরদিকে সরকার বংশের নেতা ও চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ গ্রামের বাড়ীতেই থাকেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা তিনি। দুই পক্ষের বার বার সংঘর্ষ, খুন, বাড়ীঘর লুটপাট – অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গত কয়েক বছরে কমপক্ষে অর্ধশত মামলা করেছে তারা। একাধিক সংঘর্ষে কমপক্ষে আহত হয়েছে শতাধিক। এসব ঘটনায় উভয় পক্ষের মামলায় সহস্রাধিক আসামী করা হয়। তার মধ্য দুই চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক প্রত্যেকে তিন চারটি করে খুনের মামলার আসামী। এরপরও তারা দুজনকে থামানো যাচ্ছেনা। এমনকি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতৃবৃন্দ, ভৈরব পৌরসভার সাবেক মেয়র, ৬ ইউপি চেয়ারম্যান, এলাকার গণমান্য ব্যক্তিবর্গ, পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন সন্মিলিতভাবে একাধিকবার চেষ্টা করেও দুই বংশের শত্রুতা মীমাংসা করতে পারছেনা যুগ যুগ যাবত। তারা কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। একারনে বার বার সংঘর্ষ হচ্ছে এই গ্রামে।

দুই বংশের শত্রুতা মীমাংসায় শান্তি কমিটি গঠ

গত রমজানের আগে মৌটুপি গ্রামের দুই পক্ষের শত্রুতা বিবাদ মীমাংসা করতে এলাকায় একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রামের মোঃ আনোয়ার শেখকে প্রধান করে ২১ সদস্যের একটি শান্তি কমিটি করা হয়। কমিটিতে পাশের শ্রীনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ হারুনউর রশিদ, সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গনি, এলাকার মুরুব্বি মৌলানা আশরাফুল ইসলাম, ডাঃ শওকত আকবরসহ মোট ২১ জনের কমিটি দুই পক্ষের মধ্য শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের পক্ষের লোকজনের স্বাক্ষর নেন। দুটি পক্ষ শান্তিতে রাজী হয়। এরই মধ্য গত ১৫ এপ্রিল শান্তি কমিটির সদস্যদের উদ্যেগে কর্তা বংশের পলাতক পরিবারের লোকজনকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে গেলে এদিন তুচ্ছ অজুহাতে সরকার বাড়ীর লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। সরকার বাড়ীর নেতা চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহর অভিযোগ, এদিন তারা তার ছেলের ওপর আক্রমন করলে ঘটনার সৃষ্টি হয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে এদিন কর্তা বাড়ীর অর্ধশত বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এদিনের ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে পাশের গ্রাম ভবানীপুরে। ১৫ এপ্রিল ঘটনার দিন ভবানীপুর গ্রামের কিছু লোক মৌটুপি গ্রামের দুই পক্ষের সাথে অবস্থান নেয়। তারপর ভবানীপুর গ্রামের মুরুব্বিরা তাদের গ্রামে যাতে বিবাদ ছড়িয়ে না পড়ে এজন্য ১৮ এপ্রিল সকালে তারা দুটি পক্ষকে নিয়ে শালিশীতে বসে। এসময় দুইপক্ষ তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের আঘাতে মিজান মিয়া নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এতে ঘটনাটি আরও বেড়ে যায়।
গ্রাম শূন্য মানুষ ও ফসলী জমি পতিত ঃ,,,,,,,,,,,
মৌটুপি গ্রামে গত বছর কর্তা বংশের নাদিম, সরকার বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়। পরে ঘটনায় শতাধিক লোককে আসামী করে থানায় মামলা করা হলে সরকার বংশের লোকজন প্রতিপক্ষ ও পুলিশের ভয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। তারা গত ঈদের আগে আদালত থেকে জামিন পায়। এর আগে গত বছর সরকার বংশের কাইয়ূম ও ইকবাল কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়। এঘটনায় পৃথকভাবে দুটি খুনের মামলা হয়ে আসামী করা হয় প্রায় দেড়শ লোককে। এই দুই খুনের ঘটনার পর গত এক বছর যাবত কর্তা বংশের অর্ধশত পরিবার পলাতক জীবনযাবন করছিল। কয়েকদিন আগে তারা আদালত থেকে জামিন পেয়েও বাড়ীতে আসতে পারছিলনা সরকার বংশের লোকজনের ভয়ে। গত ১৫ এপ্রিল তারা বাড়ীতে আসলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাঁধে।
গত বছর দুটি খুনের পর কর্তা বংশের লোকজন বাড়ীতে আসতে না পারায় এলাকার প্রায় দুশ বিঘা জমি পতিত থাকে। তাদের ফসলী জমিতে তারা ফসল করতে পারেনি। অপরদিকে সরকার বাড়ীর লোকজন জমিতে ফসল করার পরও তারা কর্তা বংশের লোজনের ভয়ে ধান কাটা নিয়ে শংকিত আছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও মসজিদে মুছুল্লি নেই ঃ,,,,,,,
আজ শনিবার সকালে সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, গ্রামের মানুষ পলাতক থাকায় তিনটি প্রাইমারী স্কুল ও তিনটি মাদ্রাসায় কোন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়না। মৌটুপি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আজহারুল হক জানান, আমার স্কুলে শিক্ষার্থী ৬৮ জন। বর্তমানে উপস্থিত হয় ৫/৭ জন। এলাকার মসজিদের ইমাম জহিরুল হক জানান মসজিদে ৫ ওয়াক্তে লোক হয়না। কারন গ্রামের লোকজন পলাতক। প্রতি ওয়াক্তে ৫/৬ জন মুছুল্লি হয় নামাজে।
শান্তি কমিটির প্রধান আনোয়ার শেখ জানান, আমরা এলাকায় শান্তি আনতে ২১ সদস্যের কমিটি করেছিলাম রমজানের আগে। দুই পক্ষের সম্মতিতে শান্তি কমিটি করে লিখিত নিয়েছিলাম। কথা ছিল ঈদের পর আমরা বসব। এরই মধ্য গত ১৫ এপ্রিল তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। ১৮ এপ্রিল ভবানীপুর গ্রামে মিজান খুন হলো। এখন আর মীমাংসার বিষয় কি হবে জানিনা।
এবিষয়ে সরকার বংশের নেতা ও চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা শান্তির লক্ষ্যে শান্তি কমিটির প্রস্তাব মেনেছিলাম। কিন্ত গত ১৫ এপ্রিল কর্তা বংশের লোকজন আমার ছেলে নাহিদের ওপর হামলা চালালে ঘটনাটি বেড়ে যায়, সংঘর্ষ বাঁধে। তিনি বলেন কর্তা বংশের লোকজন স্বাধীনতা পূর্বকালে আমাদের বংশের ওয়াহাব মিয়াকে খুন করে। ২০ বছর আগে তারা আমার দুই ভাইকে হত্যা করে। গত বছর আমার বংশের কাইয়ূম ও ইকবালকে খুন করে। তারা একের পর এক খুন করে যাচ্ছে। কিভাবে ঘটনা মীমাংসা করব। কর্তা বংশের তোফাজ্জল হক শহরে থেকে এসব ঘটনার সৃষ্টি করছে। গত বছর তারা আমার বংশের শতাধিক ঘরবাড়ী ধ্বংস, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছে। আমাদের জমির ফসল জোর করে কেটে নিয়ে গেছে। এভাবে মীমাংসা হবেনা।
এব্যাপারে কর্তা বংশের নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক বলেন, সরকার বংশের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাফায়েত উল্লাহর বাবা আবুবকর সিদ্দিক আমাদের বংশের কফিল উদ্দিনকে ১৯৭২ সালে জবাই করে হত্যা করে। এরপর গত বছর আমার বংশের নাদিমকে খুন করে। এছাড়াও আমাদের বংশের আরও লোককে তারা হত্যা করেছে। বার বার তারা আমাদের বাড়ীঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট করছে। গত ১৫ এপ্রিল তারা আমাদের বংশের অর্ধশত বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট করেছে । আমাদের বংশের ৫০ টি পরিবার এক বছর যাবত পলাতক জীবনযাপন করছে। সাফায়েত উল্লাহ একাধিক মামলার আসামী হয়েও বাড়ীতে থেকে এসব করছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনা। তার কারনে আজ দুই যুগ যাবত ঘটনা ঘটছে। কিভাবে ঘটনা মীমাংসা হবে। তারপরও শান্তি কমিটির প্রস্তাবে আমরা মীমাংসায় সম্মতি দিয়েছিলাম। এখন আবার নতুন ঘটনার পর মীমাংসা কি করে হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শবনম শারমিন এবিষয়ে বলেন, মৌটুপি গ্রামে দুই বংশের দাঙ্গা, সংঘর্ষ দীর্ঘদিনের। আমি শুনেছি ৫৫ বছর যাবত তাদের শত্রুতার কারনে বার বার সংঘর্ষ, খুন হচ্ছে। দুটি পক্ষের উত্তেজনায় গত ১৫ এপ্রিল ঘটনাটি ঘটে। এর তিনদিন পর ভবানীপুর গ্রামে একজন খুন হয়। আমরা নজরদারীতে রাখছি। গ্রামে আইন শৃংখলার অবনতি ঘটলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করব বলে তিনি জানান।
ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ ( ওসি) খন্দকার ফূয়াদ রুহানী এবিষয়ে জানান, মৌটুপি গ্রামের দুটি পক্ষ বংশীয়পরায়ণভাবে দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত। এগ্রামে আসামী ধরতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করে, এমন ঘটনা ঘটেছে। তারা পুলিশসহ এলাকার রাজনীতিবিদদের কথা শুনেনা। পুলিশ গ্রামের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তত। গত ১৫ এপ্রিল ঘটনায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভবানীপুর গ্রামে মৌটুপির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮ এপ্রিল একজন খুন হয়। ঘটনায় মামলা হয়েছে। তারা আবার সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা বলে তিনি জানান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

ভৈরবে যুবলীগ নেতা কর্তৃক  প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অফিসে কক্ষে মারধোর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ

ভৈরবের মৌটুপি গ্রামে আবারও দুই পক্ষের সংঘর্ষে বাড়ীঘর ভাঙচুর লুটপাট। মানুষ পালিয়েছে। শান্তি কমিটি করার পর অশান্ত হয়ে গেছে গ্রাম।

Update Time : ০৬:০৩:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

২৬ এপ্রিল, নিজস্ব প্রতিনিধি:
ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মৌটুপি গ্রামটি এলাকাবাসী ও পুলিশের কাছে দাঙ্গাবাজ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। গ্রামের কর্তা ও সরকার বংশ দুই পক্ষের শত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ৫৫ বছর যাবত চলছে ঝগড়া – সংঘর্ষ, বিবাদ। এই গ্রামে আবারও দুই পক্ষের সংঘর্ষে শতাধিক বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘরবাড়ী এখন ধ্বংসস্তুুপে পরিণত হয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল মৌটুপি গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ঘটনাটি ঘটে। এই গ্রামের বিবাদ পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে তিনদিন পর ১৮ এপ্রিল শুক্রবার সকালে মিজান মিয়া নামের একজন প্রতিপক্ষের আঘাতে নিহত হয়। এসব সংঘর্ষের ঘটনার পর একাধিক পরিবার ভয় আতংকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাড়ীঘরে থাকতে পারছেনা। কারন ধ্বংসস্তুুপ বাড়ীতে থাকার মত কোন পরিবেশ নেই, আবার প্রতিপক্ষ ও পুলিশ আতংক। বংশীয়পরায়ণ শত্রুতায় ৫৫ বছরে দুইপক্ষের ১৮ জন খুন হয়েছে। গ্রামের আধিপত্য ও শত্রুতার নেপথ্যের নায়ক দুই ইউপি চেয়ারম্যান। একজন সাদেকপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মোঃ সাফায়েত উল্লাহ। তিনি সরকার বংশের নেতৃত্ব দেন। অপরজন একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা মোঃ তোফাজ্জল হক। তিনি কর্তা বংশের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তারা বংশ পরায়ণভাবে একে অপরের শত্রু। একদিকে তাদের দল, অপরদিকে চেয়ারম্যান হওয়ার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা তাদের গোস্টির লোকজন নিয়ে বার বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কর্তা বংশের নেতা তোফাজ্জল হক বাড়ীতে থাকেননা, থাকেন ভৈরব শহরের বাসায়। শহরে থেকেই বিএনপির রাজনীতি করেন এবং গ্রামের আধিপত্বের কলকাঠি নাড়েন বংশের লোকজন দিয়ে। অপরদিকে সরকার বংশের নেতা ও চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ গ্রামের বাড়ীতেই থাকেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা তিনি। দুই পক্ষের বার বার সংঘর্ষ, খুন, বাড়ীঘর লুটপাট – অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গত কয়েক বছরে কমপক্ষে অর্ধশত মামলা করেছে তারা। একাধিক সংঘর্ষে কমপক্ষে আহত হয়েছে শতাধিক। এসব ঘটনায় উভয় পক্ষের মামলায় সহস্রাধিক আসামী করা হয়। তার মধ্য দুই চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক প্রত্যেকে তিন চারটি করে খুনের মামলার আসামী। এরপরও তারা দুজনকে থামানো যাচ্ছেনা। এমনকি স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতৃবৃন্দ, ভৈরব পৌরসভার সাবেক মেয়র, ৬ ইউপি চেয়ারম্যান, এলাকার গণমান্য ব্যক্তিবর্গ, পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন সন্মিলিতভাবে একাধিকবার চেষ্টা করেও দুই বংশের শত্রুতা মীমাংসা করতে পারছেনা যুগ যুগ যাবত। তারা কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। একারনে বার বার সংঘর্ষ হচ্ছে এই গ্রামে।

দুই বংশের শত্রুতা মীমাংসায় শান্তি কমিটি গঠ

গত রমজানের আগে মৌটুপি গ্রামের দুই পক্ষের শত্রুতা বিবাদ মীমাংসা করতে এলাকায় একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রামের মোঃ আনোয়ার শেখকে প্রধান করে ২১ সদস্যের একটি শান্তি কমিটি করা হয়। কমিটিতে পাশের শ্রীনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ হারুনউর রশিদ, সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গনি, এলাকার মুরুব্বি মৌলানা আশরাফুল ইসলাম, ডাঃ শওকত আকবরসহ মোট ২১ জনের কমিটি দুই পক্ষের মধ্য শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের পক্ষের লোকজনের স্বাক্ষর নেন। দুটি পক্ষ শান্তিতে রাজী হয়। এরই মধ্য গত ১৫ এপ্রিল শান্তি কমিটির সদস্যদের উদ্যেগে কর্তা বংশের পলাতক পরিবারের লোকজনকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে গেলে এদিন তুচ্ছ অজুহাতে সরকার বাড়ীর লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। সরকার বাড়ীর নেতা চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহর অভিযোগ, এদিন তারা তার ছেলের ওপর আক্রমন করলে ঘটনার সৃষ্টি হয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে এদিন কর্তা বাড়ীর অর্ধশত বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এদিনের ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে পাশের গ্রাম ভবানীপুরে। ১৫ এপ্রিল ঘটনার দিন ভবানীপুর গ্রামের কিছু লোক মৌটুপি গ্রামের দুই পক্ষের সাথে অবস্থান নেয়। তারপর ভবানীপুর গ্রামের মুরুব্বিরা তাদের গ্রামে যাতে বিবাদ ছড়িয়ে না পড়ে এজন্য ১৮ এপ্রিল সকালে তারা দুটি পক্ষকে নিয়ে শালিশীতে বসে। এসময় দুইপক্ষ তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের আঘাতে মিজান মিয়া নামের এক ব্যক্তি খুন হয়। এতে ঘটনাটি আরও বেড়ে যায়।
গ্রাম শূন্য মানুষ ও ফসলী জমি পতিত ঃ,,,,,,,,,,,
মৌটুপি গ্রামে গত বছর কর্তা বংশের নাদিম, সরকার বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়। পরে ঘটনায় শতাধিক লোককে আসামী করে থানায় মামলা করা হলে সরকার বংশের লোকজন প্রতিপক্ষ ও পুলিশের ভয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। তারা গত ঈদের আগে আদালত থেকে জামিন পায়। এর আগে গত বছর সরকার বংশের কাইয়ূম ও ইকবাল কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়। এঘটনায় পৃথকভাবে দুটি খুনের মামলা হয়ে আসামী করা হয় প্রায় দেড়শ লোককে। এই দুই খুনের ঘটনার পর গত এক বছর যাবত কর্তা বংশের অর্ধশত পরিবার পলাতক জীবনযাবন করছিল। কয়েকদিন আগে তারা আদালত থেকে জামিন পেয়েও বাড়ীতে আসতে পারছিলনা সরকার বংশের লোকজনের ভয়ে। গত ১৫ এপ্রিল তারা বাড়ীতে আসলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাঁধে।
গত বছর দুটি খুনের পর কর্তা বংশের লোকজন বাড়ীতে আসতে না পারায় এলাকার প্রায় দুশ বিঘা জমি পতিত থাকে। তাদের ফসলী জমিতে তারা ফসল করতে পারেনি। অপরদিকে সরকার বাড়ীর লোকজন জমিতে ফসল করার পরও তারা কর্তা বংশের লোজনের ভয়ে ধান কাটা নিয়ে শংকিত আছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও মসজিদে মুছুল্লি নেই ঃ,,,,,,,
আজ শনিবার সকালে সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, গ্রামের মানুষ পলাতক থাকায় তিনটি প্রাইমারী স্কুল ও তিনটি মাদ্রাসায় কোন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়না। মৌটুপি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আজহারুল হক জানান, আমার স্কুলে শিক্ষার্থী ৬৮ জন। বর্তমানে উপস্থিত হয় ৫/৭ জন। এলাকার মসজিদের ইমাম জহিরুল হক জানান মসজিদে ৫ ওয়াক্তে লোক হয়না। কারন গ্রামের লোকজন পলাতক। প্রতি ওয়াক্তে ৫/৬ জন মুছুল্লি হয় নামাজে।
শান্তি কমিটির প্রধান আনোয়ার শেখ জানান, আমরা এলাকায় শান্তি আনতে ২১ সদস্যের কমিটি করেছিলাম রমজানের আগে। দুই পক্ষের সম্মতিতে শান্তি কমিটি করে লিখিত নিয়েছিলাম। কথা ছিল ঈদের পর আমরা বসব। এরই মধ্য গত ১৫ এপ্রিল তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। ১৮ এপ্রিল ভবানীপুর গ্রামে মিজান খুন হলো। এখন আর মীমাংসার বিষয় কি হবে জানিনা।
এবিষয়ে সরকার বংশের নেতা ও চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা শান্তির লক্ষ্যে শান্তি কমিটির প্রস্তাব মেনেছিলাম। কিন্ত গত ১৫ এপ্রিল কর্তা বংশের লোকজন আমার ছেলে নাহিদের ওপর হামলা চালালে ঘটনাটি বেড়ে যায়, সংঘর্ষ বাঁধে। তিনি বলেন কর্তা বংশের লোকজন স্বাধীনতা পূর্বকালে আমাদের বংশের ওয়াহাব মিয়াকে খুন করে। ২০ বছর আগে তারা আমার দুই ভাইকে হত্যা করে। গত বছর আমার বংশের কাইয়ূম ও ইকবালকে খুন করে। তারা একের পর এক খুন করে যাচ্ছে। কিভাবে ঘটনা মীমাংসা করব। কর্তা বংশের তোফাজ্জল হক শহরে থেকে এসব ঘটনার সৃষ্টি করছে। গত বছর তারা আমার বংশের শতাধিক ঘরবাড়ী ধ্বংস, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছে। আমাদের জমির ফসল জোর করে কেটে নিয়ে গেছে। এভাবে মীমাংসা হবেনা।
এব্যাপারে কর্তা বংশের নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক বলেন, সরকার বংশের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাফায়েত উল্লাহর বাবা আবুবকর সিদ্দিক আমাদের বংশের কফিল উদ্দিনকে ১৯৭২ সালে জবাই করে হত্যা করে। এরপর গত বছর আমার বংশের নাদিমকে খুন করে। এছাড়াও আমাদের বংশের আরও লোককে তারা হত্যা করেছে। বার বার তারা আমাদের বাড়ীঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট করছে। গত ১৫ এপ্রিল তারা আমাদের বংশের অর্ধশত বাড়ীঘর ভাঙচুর, লুটপাট করেছে । আমাদের বংশের ৫০ টি পরিবার এক বছর যাবত পলাতক জীবনযাপন করছে। সাফায়েত উল্লাহ একাধিক মামলার আসামী হয়েও বাড়ীতে থেকে এসব করছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনা। তার কারনে আজ দুই যুগ যাবত ঘটনা ঘটছে। কিভাবে ঘটনা মীমাংসা হবে। তারপরও শান্তি কমিটির প্রস্তাবে আমরা মীমাংসায় সম্মতি দিয়েছিলাম। এখন আবার নতুন ঘটনার পর মীমাংসা কি করে হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শবনম শারমিন এবিষয়ে বলেন, মৌটুপি গ্রামে দুই বংশের দাঙ্গা, সংঘর্ষ দীর্ঘদিনের। আমি শুনেছি ৫৫ বছর যাবত তাদের শত্রুতার কারনে বার বার সংঘর্ষ, খুন হচ্ছে। দুটি পক্ষের উত্তেজনায় গত ১৫ এপ্রিল ঘটনাটি ঘটে। এর তিনদিন পর ভবানীপুর গ্রামে একজন খুন হয়। আমরা নজরদারীতে রাখছি। গ্রামে আইন শৃংখলার অবনতি ঘটলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করব বলে তিনি জানান।
ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ ( ওসি) খন্দকার ফূয়াদ রুহানী এবিষয়ে জানান, মৌটুপি গ্রামের দুটি পক্ষ বংশীয়পরায়ণভাবে দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত। এগ্রামে আসামী ধরতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করে, এমন ঘটনা ঘটেছে। তারা পুলিশসহ এলাকার রাজনীতিবিদদের কথা শুনেনা। পুলিশ গ্রামের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তত। গত ১৫ এপ্রিল ঘটনায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভবানীপুর গ্রামে মৌটুপির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮ এপ্রিল একজন খুন হয়। ঘটনায় মামলা হয়েছে। তারা আবার সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা বলে তিনি জানান।