২৫ এপ্রিল, নিজস্ব প্রতিনিধি:
ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় এখন নেতাকর্মী শূন্য। অফিসের বিদ্যুত লাইনটি বিচ্ছিন্ন থাকায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মানবশূন্য অফিসে থাকে ভূতের ভয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আর সরকার পতনের সাথে সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। এদিনই সরকার বিরোধীরাসহ দুর্বত্তরা উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অফিসে টাইলস দিয়ে তৈরি বঙ্গবন্ধুসহ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, পলাতক শেখ হাসিনা, প্রয়াত মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম আইভি রহমান, সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন এবং অন্যান্য জাতীয় নেতাদের ছবি ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে দেয় দুর্বত্তরা । ভাঙচুর করা ছবিগুলিতে কাল কালি দিয়ে মুছে দেয়া হয়। অফিসের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর, দরজা – জানালা, গেইট লুটপাট করে দুর্বত্তরা। এমনকি অফিসের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ক্ষুব্ধ লোকজন।

আজ শুক্রবার বিকেলে অফিসটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় অফিসটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। অফিসের কয়েকটি কক্ষের দেয়াল, দরজা জানালা কিছুই নেই। কক্ষগুলিতে নেই কোন আসবাপত্র। সবই লুট হয়ে গেছে। মানবশূন্য অফিসটির সামনের জায়গাতে ময়লা আবর্জনা পড়ে আছে। জরাজীর্ণ অফিসটি দেখলে মনে হয় ভূতের ঘর।
একসময় অফিসটি ছিল কোলাহল নেতাকর্মীদের সভা সমাবেশ জমজমাট আড্ডা। ভৈরবের কৃতি সন্তান আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা, এক সময়ের মন্ত্রী ও সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নিয়মিত পদচারণা ছিল ভৈরব আওয়ামী লীগ অফিসে। যতটুকু জানা গেছে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভৈরব বাজার হুলুদ পট্রিতে এই অফিসটি নেয়া হয়। সরকারী সম্পত্তি বৈধভাবে লীজ নিয়ে তৎসময়ের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্জ মোঃ সায়দুল্লাহ মিয়ার নামে অফিসটি লীজ নেয়া হয়। অফিসের কয়েকটি কক্ষ আছে। কক্ষগুলিতে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পৃথক রুম রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নাজমুল হাসান পাপন প্রায় সময় ভৈরবে আসলে অফিসে এসে সভা করতেন, নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা – মতবিনিময় করতেন। ১৯৯৬ সালে জিল্লুর রহমান মন্ত্রী ও ২০০৯ সালে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হলে এই অফিসটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জিল্লুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর ও বিশ্বাসযোগ্য নেতা ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সায়দুল্লাহ মিয়া। তারপরে এক সময় আবুল মনসুর ও পরে জাহাংগীর আলম সেন্টু সাধারণ সম্পাদক হলে তারা ছিল ভৈরবের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর। তবে জিল্লুর রহমানের নিকটআত্মীয় ও সাবেক এপিএস মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ অলিখিত ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা নেতা ছিলেন। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম বাকী বিল্লার দাপটও কম ছিলনা। ভৈরবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বানিজ্য, বদলী বানিজ্য, বিভিন্ন দফতরে তদবির বানিজ্য সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা কয়েকজন। এসব বানিজ্য, তদবির, চাঁদাবাজিসহ অর্থ আদায়ের স্থান ছিল আওয়ামী লীগের ভৈরব কার্যালয়। জিল্লুর রহমানের সহধর্মীনি, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম আইভি রহমানও জীবিত থাকতে এই অফিসে আসতেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিয়মিত অফিসে পদচারণা ছিল । সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই অফিসে ছিল জমজমাট আড্ডাখানা ও আলোচনার স্থান। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভৈরবের বড় ক্ষমতাধর ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সায়দুল্লাহ মিয়া। এসময়ে তার কথা ছাড়া ভৈরবের গাছের পাতাও নড়তনা। তিনি যা বলতেন তা শুনতেন জিল্লুর রহমান ও তার পুত্র নাজমুল হাসান পাপন। কথিত আছে সায়দুল্লাহ মিয়া কম করে হলেও ২০/৩০ কোটি টাকার মালিক। ২০১৮ সালে তিনি বিনাভোটে ( ছাপানো ভোটে) উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তৎসময়ে তাকে পাপনই বিনাভোটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। সেই বছরে সুষ্ঠু ভোট হলে দলের নেতা আবুল মনসুর বিজয়ী হতেন। অবশ্য ২০২৪ সালে আবুল মনসুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছেন সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে। কিন্ত বর্তমান সরকার পরিষদ বাতিল করে দেয়। ভৈরবের আরেক ক্ষমতাধর ছিলেন এপিএস মোঃ সাখাওয়াৎ উল্লাহ। কথিত আছে তিনিও অবৈধ বানিজ্য ও বিভিন্ন তদবির করে কম করে হলেও এখন ২০/৩০ কোটি টাকার মালিক। দুদক তদন্ত করলেই এসব বেরিয়ে আসবে। সরকার ৫ আগস্ট পতনের পর থেকে স্থানীয় ক্ষমতাধর নেতৃবৃন্দসহ অধিকাংশ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ্য শেখ হাসিসার নিকট আত্মীয় ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। সেই সূত্রে নাজমুল হাসান পাপনও হাসিনার ঘনিষ্ট আত্মীয়। শেখ রেহানার স্বামী ডঃ শফিক সিদ্দিকী হলো পাপনের আপন খালাত ভাই। অর্থাৎ জিল্লুর রহমানের ভায়রার ছেলে শেখ রেহেনার স্বামী। পাপনের আরেক খালাত ভাই শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী। পাপনের নানার বাড়ী ভৈরবের চন্ডিবের গ্রামে। একারনে জিল্লুর রহমান ও তার পুত্র পাপনের দাপটে ছিল অনেক বেশী। আর সেই দাপটে চলত ভৈরবের কয়েকজন নেতা। সরকার পতনের আগেই পাপন বিদেশে পালিয়ে গেছে বলে শোনা যায়। আর স্থানীয় ক্ষমতাধর নেতারাও এখন পালিয়ে গেছে। তবে স্থানীয় কয়েকশ নেতাকর্মী এখন মামলায় পড়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, আবার কেউ কেউ আদালত থেকে জামিন পেয়েও এলাকায় নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসে এখন কাউকে দেখা যায়না। ভৈরব বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে অফিসটি অবস্থিত হলেও দলীয় অফিসটিতে এখন কোন মানুষ তাকায়না ভয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে স্থানীয় কয়েকজন নেতার দাপটে আমরা পাপনের ধারে কাছে ভীড়তে পারতামনা। সায়দুল্লাহ মিয়াসহ কয়েকজন নেতা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে এখন তারা শতকোটি টাকার মালিক। তারা পালিয়ে গেলেও নিরীহ নেতাকর্মীদের বিপদে কোন খোঁজখবর রাখেনা। ভৈরবের রাজনীতি ধ্বংস করেছে পাপনসহ কয়েকজন। দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বদলী বানিজ্য, তদবির তারাই করেছে। তাদের সবার বিচার হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। আরেক নেতা জনপদ সংবাদকে বলেন, আমরা অফিসের খবর নিয়ে কি করব। যারা লুটপাট করেছে, দলকে ডুবিয়েছে তারা খোঁজ নিবে। পাপনতো আর দেশে আসবেনা। তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে কামিয়েছেন। এটাকা দিয়ে পাপন সারাজীবন পরিবারসহ বিদেশে খেয়ে পড়ে থকতে পারবেন। পাপন ভৈরবের রাজনীতি ধ্বংস করে গেছেন। আর সায়দুল্লাহ মিয়া আর সাখাওয়াত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাদের কোন সমস্যা নেই। তারা আর রাজনীতি না করলেও চলবে। এখন বিপদের দিনে তারা কেউ সাধারণ নেতাকর্মীদের কোন খোঁজখবর রাখেনা। এদের কঠোর বিচার হওয়া উচিত তিনি মনে করেন।